1 C
New York

কতটা সফল মোদি-পুতিনের বৈঠক

ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে ২৩তম বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন শুক্রবার নয়াদিল্লিতে সম্পন্ন হয়েছে। সম্মেলনে দুই দেশের নেতারা তাদের দীর্ঘদিনের কৌশলগত অংশীদারত্বকে ‘সফল, সহনশীল ও অগ্রগতিশীল’ বলে বর্ণনা করেছেন। 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিভিন্ন খাতে বিস্তৃত সহযোগিতাকে আরও দৃঢ় করতে সম্মত হয়েছেন। জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক স্থিতিশীলতার এক বড় উদাহরণ।

বাণিজ্য, জ্বালানি, মহাকাশ ও প্রতিরক্ষায় বড় অগ্রগতির তথ্য এসব দাবিকে বেশ স্পষ্ট করে তুলেছে।

এই বৈঠকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে।

দুই দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের আন্তবাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

এর জন্য ‘প্রোগ্রাম–২০৩০’ নামে সহযোগিতা কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে—যেখানে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্প উৎপাদন, অবকাঠামো ও সংযুক্ত পরিবহন ব্যবস্থার মতো বিভিন্ন খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, বর্তমানে ভারত রাশিয়া থেকে বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি করে। এর বড় অংশই অপরিশোধিত তেল। বিপরীতে ভারতে রাশিয়ায় রপ্তানি করে মাত্র পাঁচ বিলিয়ন ডলারের মতো।

এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভারতীয় কৃষি ও অন্যান্য পণ্যের আমদানি বাড়াতে রাশিয়া আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

ভারতে ইতোমধ্যে রাশিয়ার সহযোগিতায় একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির কাজ চলছে।

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে রুশ নকশায় দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। ভারতও এই প্রকল্পের জন্য জায়গা বরাদ্দ করতে সম্মত হয়েছে।

যৌথ বিবৃতিতে, তামিলনাড়ু রাজ্যের কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাকি অংশের নির্মাণ অগ্রগতি, সরঞ্জাম ও জ্বালানি সরবরাহের সময়সূচি মেনে চলার বিষয়ে চুক্তি হয়েছে।

এ ছাড়া, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়গুলোও উল্লেখ করা হয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, বৈঠকে পুতিন ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির জন্য ‘নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ’ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রেও দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর করার প্রচেষ্টা চলছে।

যৌথ বিবৃতিতে সামরিক ও সামরিক প্রযুক্তিগত সহযোগিতাকে অংশীদারত্বের অন্যতম ‘প্রধান স্তম্ভ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

রাশিয়ার তৈরি অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের খুচরা যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য সামগ্রী ভারতে যৌথভাবে উৎপাদনের বিষয়ে দুইপক্ষ একমত হয়েছে। এমনকি এসব পণ্য ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির আওতায় তৃতীয় বন্ধুপ্রতীম দেশেও রপ্তানি করতে পারবে ভারত।

মোদি ও পুতিন সাম্প্রতিক যৌথ সামরিক মহড়া ‘ইন্দ্রা’র ফলাফলেও সন্তোষ প্রকাশ করেন।

নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ভারতের জন্য এই যৌথ উৎপাদন মডেল গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এখনো রাশিয়ার ওপর প্রতিরক্ষা নির্ভরতা রয়েছে। এই উদ্যোগে অস্ত্র বাণিজ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলা নিয়ে অনিশ্চয়তা কমবে।

ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’ এবং রাশিয়ার ‘রসকসমস’ রকেট ইঞ্জিন উৎপাদন ও ভবিষ্যতে একসঙ্গে উৎক্ষেপণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উত্তর–দক্ষিণ পরিবহন করিডোর এবং চেন্নাই–ভ্লাদিভোস্তক সামুদ্রিক করিডোর সংক্রান্ত অবকাঠামো উন্নয়নেও দুই দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

ভারত রাশিয়ার স্পষ্ট সমর্থন পেয়েছে কূটনৈতিক বিষয়ে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণাঙ্গ সমর্থন দিয়েছে রাশিয়া। পাশাপাশি ব্রিকস–এ ২০২৬ সালে ভারতের সভাপতিত্ব পাওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, বৈঠকে মোদি রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে ‘ধ্রুবতারার মতো অটল’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং পুতিনের নেতৃত্ব ও দূরদৃষ্টির প্রশংসা করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপড়েনের সময় পুতিনকে নয়াদিল্লিতে অভ্যর্থনা জানানোকে নিউইয়র্ক টাইমস ‘ভারতের কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রদর্শন’ বলে বর্ণনা করেছে।

কার্নেগি রাশিয়া–ইউরেশিয়া সেন্টারের পরিচালক আলেকজান্ডার গাবুয়েভ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে পড়ার পর রাশিয়ার চীনের ওপর নির্ভরতা কমানো জরুরি হয়ে উঠেছে। আর সেই কারণেই ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে।

নয়াদিল্লিভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষক আলেক্সেই জাখারভ বলেন, এখন ভারতের বাজারে রাশিয়ার ব্যবসাখাতগুলোর মানিয়ে নেওয়া ছাড়া অন্য পথ নেই—এটি নতুন বাস্তবতাকে নির্দেশ করে।

সামগ্রিকভাবে বৈঠকে গৃহীত বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, পারমাণবিক প্রযুক্তি এবং কূটনৈতিক অঙ্গীকারগুলো একসঙ্গে ইঙ্গিত দেয় যে ভারত ও রাশিয়া সম্পর্ক নতুন একপর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

জটিল বৈশ্বিক পরিবেশেও দুই দেশের নেতৃত্ব সম্পর্ককে স্থিতিশীল ও ভবিষ্যৎমুখী রাখার চেষ্টা করছে—যা বৈঠকের সার্বিক বার্তায় স্পষ্ট।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এটিই পুতিনের এমন এক বিদেশ সফর, যা আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যেও দক্ষিণ এশীয় কূটনীতিতে রাশিয়ার সক্রিয় থাকার ইঙ্গিত দেয়।

Related Articles

Latest Articles