1 C
New York

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার: গানের ভুবনে এক গীতিকবির অম্লান পদচিহ্ন

গত শতাব্দীর পঞ্চাশ—আশির দশকের অনেক বাংলা গানই আজও শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। সেসব গানের কল্যাণে হেমন্ত, মান্না দে, সন্ধ্যা, লতা, গীতা দত্ত, শ্যামল, কিশোর, আশাসহ অনেককেই মানুষ আজও মনে রেখেছেন। তবে এই গানগুলোর শিল্পীদের চিনলেও গীতিকার কে— তা হয়তো অনেকেই অতটা খেয়াল করে দেখেন না।  

সে সময়ের এমন অনেক গভীর বাণীর শ্রোতাপ্রিয় গানের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সর্বকালের সেরা বিশ বাংলা গানে তার লেখা দুটি গান (কফি হাউসের সেই আড্ডাটা ও মুছে যাওয়া দিনগুলি) স্থান পেয়েছে।  

গৌরীপ্রসন্ন ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র৷ কলেজে পড়ার সময় কালীদাসের মেঘদূত কাব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তিনি মূলত কবিতাই লিখতে চেয়েছিলেন, হতে চেয়েছিলেন কবি। সেখান থেকে হয়ে উঠলেন গীতিকবি।  

তরুণ বয়সে প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক অনুপম ঘটকের জন্য ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪) সিনেমার গান লেখেন। ‘কে তুমি আমারে ডাকো’ কিংবা ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’— গানগুলোতে অনুপমবাবুর করা ডিমিনিশিং কর্ডের প্রয়োগ আজও অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। গৌরীপ্রসন্ন সেই সুরের সঙ্গে সার্থক মেলবন্ধন ঘটানো এই গানগুলো লিখেছিলেন কবিতার মতো করেই।  

শচীন দেববর্মণ তাকে মূলত গান লিখতে উৎসাহিত করতেন। শচীনকর্তার জন্য তিনি ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’ এর মতো গান লিখেছেন। সেখানে লিখেছেন— ‘শ্রবণে বিষ ঢালে শুধু বাঁশি/ শুকায় ও প্রাণ গরলে/ ঘুঁচাবো তার নষ্টামি আজ আমি/ সঁপিব তায় অনলে।’ 

গৌরীপ্রসন্নের ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ছিলো প্রখ্যাত সুরস্রষ্টা ও সঙ্গীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষের সাথে। তারা একসাথে সৃষ্টি করেছেন বহু কালজয়ী গান। যেমন— নিশিরাত বাঁকাচাঁদ আকাশে, নীড় ছোট ক্ষতি নেই, সূর্য ডোবার পালা, মেঘ কালো আঁধার কালো, মৌবনে আজ মৌ জমেছে, চিরদিনের সেই গান বলে দাও, লাল নীল সবুজের, মানুষ খুন হলে পরে, ফুল পাখি বন্ধু আমার ছিলো, এ ব্যথা কী যে ব্যথা, যদি জানতে চাও তুমি, এক গোছা রজনীগন্ধা, ক ফোঁটা চোখের জল, যদি কাগজে লেখো নাম, এই মোম জোছনায়,  আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে  ইত্যাদি।  

গৌরীপ্রসন্নের গান নিয়ে অজস্র কথা লেখা যাবে। তবে তার গানের কবিতা হয়ে ওঠার ব্যাপারটি বহুভাবেই লক্ষণীয়৷ যেমন— ‘যদি কাগজে লেখো নাম’ গানে লিখেছেন— ‘হৃদয় আছে যার সেই তো ভালোবাসে/ প্রতিটি মানুষেরই জীবনে প্রেম আসে…’ কিংবা ‘গভীর হয় গো যেখানে ভালোবাসা/ মুখে তো সেখানে থাকে না কোনো ভাষা।’ 

‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’ গানে লিখেছেন— ‘ভাঙা ঘরে দুদিনেরই খেলাঘর /হোক ভাঙা তবু এলো জোছনা/ ফুলে ফুলে ছেয়ে গেলো বালুচর/ স্বপ্নবাসর করি রচনা।’ 

কিংবা ‘নীড় ছোট, ক্ষতি নেই’ গানটিতে লেখা— ‘সুদূর পিয়াসী পাখা কাঁপে থরোথরো/ এ মন বলাকা মোর অজানার আহ্বানে / চঞ্চল পাখা মেলে ধরো/ নীড় ছোট ক্ষতি নেই/ আকাশ তো বড়।’

তার গানের কথায় গভীর সংবেদনশীলতার ছাপ স্পষ্ট। ‘ক’ফোঁটা চোখের জল’ গানে যেমন লিখেছেন— ‘হাজার কাজের ভিড়ে সময় তো হয়নি তোমার/ শোনো নি তো কান পেতে অস্ফুট কোনো কথা তার।’

অনুরাগ বসুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মান্না দে জানিয়েছিলেন, তার গাওয়া বাংলা গানগুলোর ভেতর নচিকেতা ঘোষের সুরারোপিত এই গানটিই তিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন।

গৌরীপ্রসন্ন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর জন্য ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘যে বাঁশি ভেঙে গেছে’র মতো গান লিখেছেন।  

‘তুমি আছো আমি আছি তাই/ অনুভবে তোমারে যে পাই’ (এই রাত তোমার তোমার) এর মতো রোমান্টিক লাইন যেমন লিখেছেন, তেমনি তার হাত দিয়েই এসেছে ‘ডেকো না সুরে সুরে/ দিত যে হৃদয় ভরে/ দেখো তার গানের বীণা ধূলায় প’ড়ে’ (যে বাঁশি ভেঙে গেছে)।

লুকোচুরি (১৯৫৮) সিনেমার ‘এইতো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়’, ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’—র মতো গান লিখেছেন। তার লিরিকের বৈচিত্র্য এখানে খুব ভালোভাবেই দৃশ্যমান।  

তিনি কিশোর কুমার, রাহুল দেব বর্মণ, এমনকি বাপ্পী লাহিড়ীর জন্যও গান লিখেছেন।  

কিশোরের ‘সেদিনও আকাশে ছিলো কত তারা’ গানটি লেখার সময় গৌরিপ্রসন্ন ছিলেন কিশোর কুমারের মুম্বাইয়ের বাড়িতে। সে সময় মাথায় তার কিছু আসছিলো না। বাড়ির সামনে সৈকতে বসে থাকতে থাকতে দেখেন আশপাশের গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়েছে। নিজস্ব এক অতীত স্মৃতি তাকে ব্যাকুল করে তোলে।

তিনি ফিরে এসে কাঁপা গলায় কিশোর কুমারকে বলেন, ‘কিশোর বাবু, লিখুন— সেদিনো আকাশে ছিলো কত তারা….’
এরপর পুরো গানটিই একনাগাড়ে বলে যান তিনি৷ ‘স্মৃতি নয় এতো/ ঝরাফুলে যেন/ ভালোবাসা ভরা/ তোমারি মমতা’র মতো মর্মস্পর্শী লাইন তিনি লিখেছিলেন গান হয়ে ওঠা এই কবিতায়।  

তার কাহিনী অবলম্বনে অগ্রদূত পরিচালিত ‘চিরদিনের’ (১৯৬৯) সিনেমায় তার লেখা সব গানই দারুণ হিট করে। ‘মানুষ খুন হলে পরে /মানুষই তার বিচার করে/ বিচার কেনো পায় না নিহত গোলাপ’— এমন মর্মস্পর্শী লিরিক লিখেছিলেন ‘মানুষ খুন হলে তারা পরে’ গানে। এই সিনেমার ‘চিরদিনের সেই গান বলে দাও’— এক অসামান্য সৃষ্টি।

তার সাংগীতিক উৎকর্ষের আরেকটি অবিস্মরণীয় উদাহরণ ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ (১৯৬৭) সিনেমায় লেখা গানগুলো। ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ কিংবা ‘আমি যে এ জলসাঘরে’ গানগুলো কি কেউ ভুলতে পারে? 

‘তব নামে মম প্রেম মুরলি/ পরানের গোঁঠে বাজে’ কিংবা ‘আমি যে এ জলসাঘরে বেলোয়ারি ঝাড়/ নিশিফুরালে কেহ চায়না আমায় জানি গো আর’ — ভিন্ন দুরকম ভাবের কথাতেই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। 

তার কবিপ্রতিভার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘এই মোম জোছনায়’ গানটি৷ এই গানটি তিনি লিখেছিলেন উত্তম কুমারের অনুরোধে। ‘দেখো ওই ঝিলিমিলি চাঁদ/ সারারাত রাত আকাশে সলমা জরি’র মতো চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন তিনি এই গানে, যা মূলত অতি উন্নত এক কবিতা।

রাহুল দেব বর্মণ ব্রাজিলিয়ান কুইকা দিয়ে আশির দশকে সুর করলেন পূজোর গান। ‘মাছের কাঁটা খোঁপার কাঁটা’ নামের সেই গানটিতে চপল সুরের উপযোগী লিরিক যেমন লিখলেন, আবার তার ভেতর দিলেন ভাবনার খোরাক— ‘এত পোকার মধ্যে শুধু জোনাকি দেয় বাতি’ কিংবা ‘কালো টাকা, কালো বাজার, কালো কথা মুখে/ নয়তো কালো শিশুর হাসি মায়ের শীতল বুকে’।   

এছাড়া ১৯৬৮ সালে রাহুলের সুরেই কিশোর কুমারের জন্য ‘বাম চিকি চিকি বাম বাম’ গানটি লেখেন। এটি বাংলা সঙ্গীত ইতিহাসে প্রথম র‍্যাপ গান। যদিও তখন র‍্যাপ কথাটির প্রচলন ছিলো না। 

গৌরীপ্রসন্ন বাপ্পী লাহিড়ীর জন্য ‘ময়ূর আকাশ মুঠোমুঠো তারা ‘, ‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো’, ‘ফুল ফুটে ঝরে যায়’, ‘কথা নয় যেন পাখির কূজন’ এর মতো গান লিখেছেন।  

মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে তার লেখা গান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি সিগারেটের প্যাকেটে লিখেছিলেন ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি৷ সেটা ১৯৭১ এর ৭/৮ মার্চের কথা। তখনো যুদ্ধ শুরু হয়নি, কিন্তু সাত মার্চের ভাষণ শুনেই গানটি একটানে লিখে ফেলেছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য লেখেন ‘মা গো ভাবনা কেনো’ গানটি৷  

তার শেষজীবনের অসামান্য কীর্তি ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’। গানটি তাকে লেখার কথা বলেছিলেন নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ। তিনি তখন তরুণ সুরকার। গৌরীপ্রসন্নর সঙ্গে গানটি লেখা নিয়ে সুপর্ণ’র তর্ক হয়েছিল। গৌরীপ্রসন্ন গানটাকে একরকম চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। তারপর ক্যান্সারাক্রান্ত গৌরীপ্রসন্ন রাত জেগে গানটি লেখেন। তার উদ্বিগ্ন স্ত্রী সুপর্ণকে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কী হয়েছে!  

তারপরও গানটির শেষদিকে কিছুটা অসম্পূর্ণতা রয়ে যায়৷ সুপর্ণ একটি উপসংহার চাচ্ছিলেন। গৌরীপ্রসন্ন প্রথমে না করেন। তবে পরে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ট্রেনে করে রওনা হওয়ার আগে স্টেশনে তার মাথায় আসে সেই লাইনগুলো—

‘সেই সাতজন নেই, আজ টেবিলটা তবু আছে/ সাতটা পেয়ালা আজ খালি নেই/ একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি/ শুধু সেই সেদিনের মালি নেই’— এটুকুসহ আরো কয়েকটি লাইন লিখে গানটি সম্পূর্ণ করে একজন লোককে দিয়ে সুপর্ণর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর এই গান বাংলা গানের ইতিহাসেই মাইলফলকে পরিণত হয়।

নিজের লেখা ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ গানটিকে তিনি মনে করতেন হেমন্তের গাওয়া শ্রেষ্ঠ গান। গীতিকারদের অবমূল্যায়ন করা হয় বলে মনে করতেন তিনি। জীবনের একেবারে শেষদিকে, ১৯৮৬ সালে দূরদর্শনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সব গান কবিতা নয়, তবে অনেক গানই কবিতা। কবিতা না হলে সেসব গানও হয়ে উঠতো না। তবু কবিদের সম্মেলনে কোনো গীতিকারকে কেনো ডাকা হয় না?… রবীন্দ্রনাথ তার নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছিলেন একটি গানের বইয়ের (সং অফেরিংস) জন্যই।’  

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের বহু গানই প্রকৃতপক্ষে সার্থক কবিতা। তিনি লিখেছেন, ‘কোথায় কখন কবে কোন তারা ঝরে গেলো / আকাশ কি মনে রাখে?’ (মুছে যাওয়া দিনগুলি)।

আবার তার কলম দিয়েই এসেছে— ‘আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শুনো/ আমি যদি আর না—ই আসি হেথা ফিরে/ তবু আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে।’  

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ক্ষেত্রে দুটোই সত্য, তবে দ্বিতীয় গানটির কথাই যেন বেশি সত্য।

তার জন্মশতবার্ষিকী আজ। ১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। তার পৈতৃক ভিটার কোনো চিহ্ন আজ আর নেই৷

জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলা গানের প্রবাদপ্রতিম গীতিকবি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।

Related Articles

Latest Articles