স্বাধীন বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমাদের ব্যর্থতা সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ব্যর্থতার গল্পগুলো থেকে। সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার চূড়ান্ত ভিত্তি স্থাপন করতে আমাদের প্রায় ৫৩ বছর লেগে গেছে। এখন এই ভিত্তির কেমন অট্টালিকা দাঁড় করাতে পারব, সেটা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কার্যক্রম নিয়ে আমরা যতোই সমালোচনা করি না কেন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার কারণে তারা প্রশংসার দাবিদার। প্রধান বিচারপতির অধীনস্থ একটি পৃথক সচিবালয় না থাকলে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের, বিশেষত আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাব থেকে কখনোই বেরিয়ে আসতে পারত না। আর এটাই দেশের আইনব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল। বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় স্থাপনের লক্ষ্যে সম্প্রতি একটি অধ্যাদেশ হয়েছে। এ জন্য সরকার প্রধান ড. ইউনূস এবং আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য। একইসঙ্গে বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়, যার নেপথ্যের নিরলস প্রচেষ্টাতেই এটা বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
একটি আলোচনা উপেক্ষা করা যাবে না। আর সেটা হলো—খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার, কিংবা জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকার স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
তিনটি ঘটনা—একটি রায় (১৯৯৯), একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগ (ফখরুদ্দীন আহমদ, ২০০৭) এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি উদ্যোগ (ড. ইউনূস, ২০২৫) অবশেষে সব আইনি বাধা দূর করে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছে।
১৯৯৫ সালে তৎকালীন জেলা জজ মাসদার হোসেন ৪৪১ জন অধস্তন বিচারকের পক্ষে নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি ইত্যাদিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্ট ১৯৯৭ সালের ৭ মে ৮টি সুপারিশসহ রায় দেন। সরকার আপিল করলে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ ১২টি সুপারিশসহ এক ঐতিহাসিক রায় দেন। রায়ে পৃথক জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন, জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন প্রতিষ্ঠা, সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে আলাদা সেবাবিধি প্রণয়ন, বিচারিক বেতন কমিশন প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব কমাতে আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু, এটা যথাযথভাবে পালন করা হয়নি।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন, জুডিসিয়াল সার্ভিস বিধি ও বেতন কমিশন প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত উদ্যোগটি নেওয়া হয়। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিম্ন আদালতকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করে।
২০২৫ সালের ৩০ নভেম্বর বর্তমান সরকার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ জারি করে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করে, যা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
তাহলে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতিমালার দ্বিতীয় ভাগে স্পষ্টভাবে ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন’ উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও এই কাজটি করতে আমাদের ৫৩ বছর কেন লাগলো?
এর দুটি মৌলিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, আমাদের জবাবদিহিহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং দ্বিতীয়ত, আমলাতান্ত্রের বজ্রমুষ্ঠি প্রভাব, যা কখনোই স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরির সুযোগ দেয় না। বিশেষত এমন প্রতিষ্ঠান, যেগুলো আমলাদের ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে পারে।
শুরু থেকেই আমরা শক্তিশালী সরকারের প্রত্যাশায় এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন করি, যেখানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আইনসভা, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নির্বাহী বিভাগের দিকে রেখেছি। লিংকনের ‘জনগণের সরকার জনগণের দ্বারা জনগণের জন্য’ বাণীর ভুল ব্যাখ্যা করে আমরা যেন ধরেই নিয়েছি যে, কোনো নির্বাচিত সরকারের সব কাজই জনগণের ‘ইচ্ছার’ প্রতিফলন। তাই সরকারকে ইচ্ছামতো রাষ্ট্র পরিচালনা করতে দেওয়া উচিত। শক্তিশালী সরকার গড়তে গিয়ে আমরা জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ হারিয়েছি।
শুরু থেকেই আমরা আইনসভা বা সংসদকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে দিইনি। সংসদ সবসময়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে কাজ করেছে। আমরা কখনোই সংসদ নেতা ও সরকার প্রধান, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা আলাদা করিনি। যার ফলে সংসদ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
যথাক্রমে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা কায়দ-এ-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উভয়েই সর্বোচ্চ নির্বাহী পদ দখল করেন। এর ফলে আইনসভা পুরোপুরি সরকার প্রধানের অধীনস্থ হয়ে যায়। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে তখন, যখন উভয় ক্ষেত্রেই একই ব্যক্তি সংসদ নেতা, সরকার প্রধান ও দলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এতে স্বাধীনভাবে সংসদ বিকশিত হওয়ার সামান্যতম সুযোগটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে জিন্নাহ ভারতের নেহরুর মতো প্রধানমন্ত্রী না হয়ে গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন, যে পদে পূর্বে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ছিলেন। এতে পাকিস্তানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সেই সংগ্রাম এখনও সেখানে চলছে।
অন্যদিকে, শেখ মুজিব প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। এতে করে নির্বাচিত সংসদের ভূমিকা কিছুটা জোরালো হয়। কিন্তু তিনি সংসদ নেতা ও দলীয় সভাপতির দায়িত্ব পৃথকভাবে বণ্টনের দূরদর্শিতা দেখাননি। প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান—এই তিনটি পদে একসঙ্গে থাকার ফলে ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ হয়। যার ফলে শাসনব্যবস্থাও পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত হয় এবং যার সর্বশেষ ভয়াবহ রূপ দেখা গেছে শেখ হাসিনার শাসনামলে।
স্পিকারের ভূমিকা হচ্ছে, তিনি স্বাধীন সংসদ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু, আমাদের দেশে সবসময়ই শাসক দলের অনুগত ব্যক্তি হিসেবে দেখা গেছে স্পিকারকে। যাদের স্পিকার ‘নিযুক্ত’ করা হয়েছিল তাদের দিকে তাকালেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাদের কারোই সংসদের স্বার্থকে শাসক দল কিংবা বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর স্বার্থের উপরে রাখার মতো ব্যক্তিত্ব বা সদিচ্ছা ছিল না। বেশিরভাগই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ থেকেছেন। এমনকি সর্বশেষ স্পিকার শিরিন শারমিনের কথাই ধরা যাক। তিনি নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন না, ছিলেন সংরক্ষিত নারী আসন থেকে মনোনীত সদস্য। ফলে, আইন প্রণয়নে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নয়, তাদের মনোযোগ বরং ছিল প্রধান নির্বাহীর সেবক হয়ে ওঠার দিকে।
নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভোট শেষে তারা ভোটারদের আর গুরুত্ব দেননি। বরং যে দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন, তাদের প্রতিই সম্পূর্ণ আনুগত্য দেখিয়েছেন। কারণ, তাদের সব সুবিধা, উন্নয়ন তহবিল ও বিভিন্ন নির্বাহী ক্ষমতা আসে সরকার ও শাসক দলের কাছ থেকে, ভোটারদের কাছ থেকে নয়। এর ফলে আইনসভার ভূমিকা আরও ক্ষয় হয়েছে।
সবমিলিয়ে কেবল বিচার বিভাগই ছিল এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারত। আর সেই কারণেই এর ডানা ছেঁটে ফেলার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করা হয়েছে। এখানে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা শুধু স্বাধীন বিচারব্যবস্থা গড়ে উঠতে বাধা দিয়েছেন তাই না, রাজনীতিবিদদেরও পরামর্শ দিয়েছে যে সরকারের স্বাধীন কর্মকাণ্ডে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
নিম্ন থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচার বিভাগের সদস্যরাও তাদের অধীনস্থ অবস্থা টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছেন। বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহারের প্রতিবাদে কোনো বিচারকের পদত্যাগের উদাহরণ নেই। উল্টো বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে দেখা যায় যে বিচার বিভাগ প্রতিরোধ না করে নির্বাহী হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। জামিন না দেওয়া, ভিন্নমতাবলম্বীদের কারাগারে পাঠানো, রিমান্ড মঞ্জুর করা, শুরুতেই মামলার গ্রহণযোগ্যতা খতিয়ে না দেখা, ব্যক্তির সাংবিধানিক স্বাধীনতা ও আইনি হয়রানি থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত না করা—এসব করার মাধ্যমে জনগণকে ভয় দেখানোর সুযোগ নির্বাহী বিভাগকে করে দিয়েছেন বিচার বিভাগের সদস্যরা। তারা সুবিধা পেয়ে, কখনো স্বার্থপরতার বশে ভুলে গেছেন যে আইন ন্যায়বিচারের জন্য। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যায়বিচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা হলে বিচারককে ন্যায়বিচারকেই বেছে নিতে হবে। সরকারের স্বার্থ নয়, নাগরিকের অধিকারের পক্ষে থাকতে হবে তাদের।
উদাহরণস্বরূপ, আইন স্পষ্টভাবে বলে, একটি অপরাধের জন্য কেবল একটি মামলা করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে ডজন ডজন, কখনো শত শত মামলা নেওয়া হয়েছে একই ঘটনায়। বিচার বিভাগ কেন এ নিয়ে প্রশ্ন করেনি? জামিন আবেদন নাকচ করার সময় আদালত খুব কম সময়ই বিবেচনায় নেয় যে, এর মাধ্যমে সংবিধানে দেওয়া ব্যক্তিস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। রিমান্ডের অপব্যবহার নিয়ে বিচারকদের মনে খুব কমই প্রশ্ন জাগে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে পতিত সরকারের করা মামলাগুলো যেভাবে পরিচালনা করা হয়েছে, তা বিচার বিভাগের দায়িত্ব থেকে বিচ্যুতির সবচেয়ে লজ্জাজনক উদাহরণ। দুঃখজনকভাবে, এমন কিছু চর্চা এখনও চলছে এবং আমরা আশা করি দ্রুত সেগুলো বন্ধ হবে।
শত শত মানুষকে আসামি করা এবং বহু ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রমাণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করার ফলে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি এমন পর্যায়ে নেমেছে যে, এটাকে সরকারের অঙ্গসংগঠন বলে মনে হয়। বিচার বিভাগ যুক্তি দিতে পারে, এগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ এবং তাদের এখতিয়ারের বাইরে। কিন্তু যখন আইনের এই অপব্যবহার বিচার বিভাগকেই সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তখন কি তাদের প্রকাশ্যে নিন্দা জানানো উচিত না? সরকারের প্রতি এসব বন্ধ করার আহ্বান জানানো উচিত না? উচ্চ আদালত, বিশেষত প্রধান বিচারপতি এমন আহ্বান জানাতে পারেন এবং সেটাই করা উচিত। পেশার নৈতিকতা ও নীতিবোধ থেকেই তাদের এটা করা উচিৎ।
আমরা যে বিষয়টি জোর দিয়ে বলতে চাই তা হলো, সব নিয়ম পাস হয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার পরও এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে বিচারকদের নৈতিক সাহসের ওপর। তাদের অবশ্যই ন্যায়বিচারের চেতনায় অটল থাকতে হবে, যান্ত্রিকভাবে আইনের ব্যাখ্যায় নয়। সেইসঙ্গে কখনোই নির্বাহী বিভাগ বা ‘বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত আসামি’দের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে না। বিভিন্ন আইনি ফাঁকফোকরের কারণে বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকে। প্রতিটি শুনানিতে হাজির হতে গিয়ে দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ যে দুর্ভোগে পড়েন, সময় ও অর্থ ব্যয় করেন, বিচারকদের কাছে সেটা তেমন কোনো উদ্বেগের বিষয় বলে মনে হয় না।
সুতরাং বিচারকদের—বিশেষ করে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারকদের—সবসময় বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে এবং এমন কিছু করা যাবে না, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই মহান প্রতিষ্ঠানকে অপমানিত করে। আমাদের মতে, সর্বোচ্চ আদালত নিজেদের সবচেয়ে লজ্জাজনক অপমানটি করেছে সেই সময়, যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় প্রধান বিচারপতি এস. কে. সিনহাকে অপসারণ করা হয় এবং আপিল বিভাগের বাকি পাঁচজন বিচারক কোনো ধরনের প্রতিবাদ না করে উল্টো সহযোগিতা করেন। এস. কে. সিনহাকে কেন অপসারণ করা হয়েছিল? কারণ, তিনি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে শেখ হাসিনার চাওয়া অনুযায়ী কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সেই মানুষটির পাশে দাঁড়ানোর বদলে উল্টো সেই পাঁচজন বিচারক ঘোষণা করলেন, তারা আর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কাজ করবেন না। এতে আপিল বিভাগের মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার যে উপাদানগুলো তৈরি করেছে, সেগুলো দ্রুত ও আন্তরিকতার সঙ্গে আইনে রূপান্তরিত করাই হবে আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ীদের প্রথম পরীক্ষা। আমরা আরও আশা করি, ভবিষ্যতে সংসদ সদস্যরা ভোটারদের প্রতি বেশি সম্মান দেখাবেন এবং শুধু দল, বিশেষ করে দলীয় প্রধানের প্রতি মাথা নোয়ানোর অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে আসবেন।
আমাদের প্রত্যাশা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হলে ক্ষমতাসীন সরকারের সেবায় নিয়োজিত না হয়ে বরং জনগণের সেবা করার মাধ্যমে নিজের যথাযোগ্য মর্যাদা ও গৌরব ফিরিয়ে আনবে আধুনিক সভ্যতার এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি।
যদি এবং কেবল যদি নির্বাহী বিভাগ নিজের সীমার মধ্যে থাকে; আইনসভা, বিশেষ করে সংসদ সদস্যরা দলীয় স্বার্থ বা কথিত উন্নয়ন প্রকল্পের পেছনে না ছুটে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নিজেদের নিয়োজিত রাখে এবং বিচার বিভাগ যদি সবার জন্য, বিশেষত দরিদ্রদের জন্য জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সত্যিকারের ভূমিকা পালন করে, তাহলেই আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সত্যিকারের সুযোগ পাব।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
(ইংরেজি থেকে অনুবাদ)
