1 C
New York

ইমিগ্রেশনে লেবাননগামী ৩০ প্রবাসীর ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত যা ঘটেছিল

প্রতিদিন প্রায় ১৩-১৫ হাজার যাত্রী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন অতিক্রম করে বিদেশ যান। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নানাবিধ ত্রুটিপূর্ণ কিংবা অসম্পূর্ণ ভ্রমণ দলিলাদি নিয়ে ইমিগ্রেশন ডেস্কে হাজির হন৷ যেকোনো যাত্রীর বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে মূলত তিনটা ডকুমেন্টস বিশেষভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়—১. পাসপোর্ট সঠিক ও বৈধ কি না, ২. ভ্রমণের ভিসাটি সঠিক কি না এবং ৩. এয়ারলাইনসের দেওয়া বোর্ডিং পাসটি ঠিক আছে কি না। পাশাপাশি ভ্রমণ ভিসায় গমনের ক্ষেত্রে যাত্রীর সঙ্গে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা এবং যাত্রীর রিটার্ন টিকেট আছে কি না, সেটাও দেখা হয়।

প্রথমবার বিদেশগামী যাত্রীর ক্ষেত্রেও এসব বিষয়ে খেয়াল রেখেই ইমিগ্রেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইএমএস) থেকে ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার পর তাদেরকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। অন্যথায় যাত্রা স্থগিত করা হয়। ইমিগ্রেশনে যেহেতু ২৪/৭ যাত্রীর গমনা-গমন সেবা দেওয়া হয়, তাই প্রতি শিফটের (৮ ঘণ্টায় শিফট) ক্ষেত্রেই এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে ট্রাভেল ডকুমেন্টস স্ক্রিনিং সম্পন্ন করার পর যেসব যাত্রীকে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়, তাদের বোর্ডিং পাসের উপরে ‘ওকে’ লিখে সই করা হয় ও অফিশিয়াল সিরিয়াল নম্বর দিয়ে তা রেজিস্টারে সংরক্ষণ করা হয় এবং প্রত্যেক শিফটের দায়িত্বরত কর্মকর্তা (অফিসার ইন-চার্জ) এই কার্যক্রম পরিচালনা করে তাতে সই করেন।

অপারেশনাল কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মাঝেমধ্যেই বিশেষ পুলিশ সুপার (অপারেশন্স) ওই স্ক্রিনিং প্রসেস পরিচালিত করেন এবং এক্ষেত্রে তাকে অন্যান্য অফিসাররা সহায়তা করেন। স্ক্রিনিং কার্যক্রমে যদি কোনো যাত্রীর ক্ষেত্রে উপরে উল্লেখিত ট্রাভেল ডকুমেন্টস সঠিক পাওয়া যায়, তখনই কেবল ওই যাত্রীকে আইএমএস ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়। এ কার্যক্রম বিশেষ পুলিশ সুপার (অপারেশন্স) মাঝেমধ্যেই তদারকি করেন এবং ‘ওকে’ লিখে সই করেন, যা পরবর্তীতে রেজিস্টারে সংরক্ষণপূর্বক অফিসিয়াল সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হয়। কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য এই পুরো আইএমএস প্রক্রিয়াটি ইমিগ্রেশনের রুটিন কার্যক্রমের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এসব বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাত্রীদের ফ্লাইটে অনবোর্ড করার জন্য ইমিগ্রেশন অফিসার থেকে ইমিগ্রেশনে কর্মরত সিনিয়র অফিসারদের ২৪ ঘণ্টাই সক্রিয়ভাবে কাজ করে যেতে হয়। এমন বাস্তবতায় কী ঘটেছিল অসম্পূর্ণ ভ্রমণ দলিল নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের লেবাননগামী ৩০ যাত্রীর ভাগ্যে?

২০২৫ সালের নভেম্বরের একদিন। ঘড়ির কাটায় বিকেল ৪টা ১০ মিনিট। লেবাননগামী ৩০ বাংলাদেশি যাত্রীর ফ্লাইটের সময় বাকি আছে ৩০ মিনিট। এদিকে উড়োজাহাজের গেট বন্ধ করে দেওয়া হবে ফ্লাইট ছাড়ার ২০ মিনিট আগে। সেই হিসেবে ইমিগ্রেশন অফিসারের হাতে সময় আছে ১০ মিনিট।

যাত্রীদের প্রত্যেকের কাছে থাকা ভিসার কপিগুলো ফটোকপি এবং অনলাইনে ভেরিফাই করার কোনো সুযোগ নেই। ভিসাগুলো এতটাই অস্পষ্ট যে ম্যানুয়ালি যাচাই করাও অসম্ভব। ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় ভিসা সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া গেলে এরকম ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অ্যাভিয়েশন নিয়মানুযায়ী যাত্রীদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার কোনো সুযোগ নেই। নিয়মানুযায়ী তাদেরকে অফলোড (যাত্রা সমাপ্তি) করে অফিস থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই করে তারপর ভ্রমণের অনুমতি দেওয়ার কথা। তার জন্য কতগুলো ফর্মাল চ্যানেলের কানেক্টিভিটির মাধ্যমে ভ্রমণ দলিলাদি যাচাই করতে হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় অন্তত ৩-৭ দিন।

এমন পরিস্থিতিতে ওই ৩০ যাত্রীর চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের ছাপ। এতজন নিম্নবিত্ত মানুষের যাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে তাদের টিকিটের টাকা লোকসান তো হবেই, তার ওপর বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসার বিপরীতে উল্টো ৩০ পরিবার সর্বশান্ত হবে।

এসব ভেবে সিদ্ধান্ত হলো—যেভাবে হোক লেবাননের অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করতে হবে। অনেক চেষ্টার পর সেখানকার ফার্স্ট সেক্রেটারির নম্বর সংগ্রহ করা গেল। তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিস্তারিত জানানো হলো। যাত্রীদের আর্থসামাজিক বাস্তবতার কথাও তাকে বলা হলো।

তিনি জানালেন, ভিসা কনফার্ম না হলে কোনোভাবেই যাত্রী পাঠানো এবং সেখানে রিসিভ করা ঠিক হবে না। তখন তাকে র‌্যানডমলি কয়েকটা ভিসা চেক করার জন্য অনুরোধ করা হলো। শুরুতে রাজি না হলেও অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি র‌্যানডমলি ৮-১০ জনের ভিসা চেক করতে রাজি হন। ৪-৫টি ভিসা চেক করে তিনি জানালেন, সেগুলো ঠিক আছে। ৩০ জনের সবার ভিসা চেক করা না গেলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইমিগ্রেশন বিভাগ ঝুঁকি নিয়েই তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করে।

ইতোমধ্যে নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ায় ফ্লাইটে থাকা অন্য যাত্রীদের পরিস্থিতি জানিয়ে কিছুটা সময় অপেক্ষার অনুরোধ করা হয়। দ্রুত গতিতে ওই ৩০ জনের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করা হলো। ইমিগ্রেশন বিভাগের এই তৎপরতায় এই যাত্রীরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন, ধন্যবাদ জানান। ইমিগ্রেশন বিভাগের জন্যও সেটা ছিল আনন্দের এক মুহূর্ত। সব প্রক্রিয়া শেষে ফ্লাইটে উঠে লেবাননের উদ্দেশে রওনা দেন ওই ৩০ বাংলাদেশি।

সম্রাট মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন অপারেশন্স)

Related Articles

Latest Articles