লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে প্রায় এক যুগ ধরে চলছে একটি মার্কেট। পরিবেশকর্মী ও বন কর্মকর্তারা বলছেন, এই মার্কেট বনের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্যটকের ভিড়, যানবাহনের শব্দ আর বাণিজ্যিক কার্যক্রমের কারণে বন্যপ্রাণী ও বনাঞ্চলের স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে।
জানা যায়, রেলপথ, সড়কপথ, গ্যাসলাইন ও বিদ্যুৎ লাইন লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়েই গেছে। ১৯৯৬ সালে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর আয়তনের লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। এরপর পর্যটক সংখ্যা বাড়তে থাকে।
পর্যটন সুবিধা বাড়াতে রেস্টহাউস, ছাত্রাবাস এবং প্রকৃতি ব্যাখ্যা কেন্দ্রও তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় পরিবেশকর্মী ও বন কর্মকর্তারা বলছেন, বন বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষেই বনের ভেতর মার্কেট হয়েছিলো।
লাউয়াছড়া পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বিরল ও বিপন্ন প্রাণীর আবাসস্থল। প্রতিদিন এত মানুষ ও যানবাহন আসায় বন্যপ্রাণীর জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে।
উদ্যানের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রাক্তন এই সদস্য আরও জানান, দোকানগুলো ২০১৪ সালের দিকে নির্মাণ করা হয়। বেশিরভাগ দোকানই অনিয়ম করে হয়েছে। সেসময়ের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) অনুমোদন না দিলে এগুলো হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানরেই এসব দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক সমিতি মৌলভীবাজার ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক নুরুল মোহাইমিন মিল্টন বলেন, প্রতিদিন অনেক পর্যটকের আগমন, হইচই আর যানবাহনের চাপ উদ্যানের শান্ত পরিবেশ নষ্ট করছে। পাশাপাশি গাছ চুরি, বন্যপ্রাণী শিকার এবং জ্বালানি কাঠের জন্য গাছ কাটা বন্ধ হচ্ছে না। বনের ভেতর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কারণে যত্রতত্র প্লাস্টিক ও আবর্জনা জমছে। ফলে আগের মতো বন্যপ্রাণী দেখা যায় না।
বাংলাদেশ বন্য প্রাণি সেবা ফাউন্ডেশনের (বাংলাদেশ বন্য প্রাণী যত্ন ফাউন্ডেশন) পরিচালক স্বপন দেব সজল বলেন, বন বিভাগের অনুমতি থাকায় এত বেশি পর্যটক আসে যে বন্যপ্রাণীগুলো ভয়ে পালিয়ে যায়।
বন বিভাগের তথ্য বলছে, গত বছর শ্রীমঙ্গলে ২২২টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়, এর মধ্যে ১০৪টি মৃত ছিল। বন বিভাগের পাশাপাশি বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন ও ‘স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এন্ডেঞ্জারড ওয়াইল্ডলাইফ (এসইডব্লিউ)’ উদ্ধারকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সাবেক এক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জানান, সংরক্ষিত বনের ভেতর দোকানপাট বসানো ঠিক হয়নি। এতে বন ও বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের পাবলিকেশন সেক্রেটারি সাজু মারছিয়াং বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এমনিতেই হুমকির মুখে। সময়ের সাথে সাথে বন কমছে, পর্যটক বাড়ছে, বাণিজ্যিক কার্যক্রমও বাড়ছে। এর মধ্যে এক যুগ ধরে বনের ভেতর মার্কেট থাকা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
লাউয়াছড়া পুঞ্জির বাসিন্দা হাতিম আলী লংগদ জানান, তিনি ১৯৬৪ সালে পুঞ্জিতে দোকান করেছিলেন। পরে বিভিন্ন সময়ে তাকে স্থান বদলাতে হয়। বর্তমানে বাইরে গেটের সামনে তাকে বসতে বলা হয়েছে।
তিনি দাবি করেন, তার দোকান বন বিভাগই বসিয়েছে এবং এটি বৈধ। অন্য দোকানগুলো প্রভাবশালীরা নিয়েছেন।
স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এন্ডেঞ্জারড ওয়াইল্ডলাইফের (এসইডব্লিউ) প্রতিষ্ঠাতা সোহেল শ্যাম বলেন, এসব দোকানের কারণেই পুরো বনে প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে। দোকানগুলো আরও কিছুদিন থাকলে লাউয়াছড়া প্লাস্টিকে ভরে যাবে। এতে বন ও বন্যপ্রাণী মারাত্মক সংকটে পড়বে।
দলবদ্ধ মানুষের উপস্থিতি বন্যপ্রাণীর খাবার সংগ্রহ ও চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, খাবারের সন্ধানে প্রাণীরা জনপদে এসে পড়ে এবং অনেক সময় ধরা পড়ে বা সড়কে পিষ্ট হয়ে মারা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের নবাগত বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, গত ১৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের এক সভায় লাউয়াছড়া বন রক্ষায় ৮টি নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর একটি হলো—বনের ভেতরের সব দোকান সরিয়ে ফেলা। কেবল এক বা দুটি ইকো-ফ্রেন্ডলি দোকান রাখার কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরুও হয়েছে।
