0.4 C
New York

দরিদ্র পরিবারে শিশু-মৃত্যু বেশি, মায়েদের স্বাস্থ্যসেবায় তীব্র বৈষম্য

বাংলাদেশের দরিদ্র পরিবার দুই দিক দিয়েই বৈষম্যের শিকার। একদিকে পাঁচ বছরের আগেই শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি তাদের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ, অন্যদিকে প্রসূতি মায়েরা ধনীদের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ স্বাস্থ্যসেবা পান।

ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিক্স) ২০২৫–এ উঠে এসেছে এই উদ্বেগজনক চিত্র। জরিপে অংশ নেয় প্রায় ৬৩ হাজার পরিবার।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত বৈষম্য দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জীবন-মৃত্যুর ব্যবধানে সরাসরি ভূমিকা রাখছে।

জরিপে দেখা গেছে, দরিদ্রতম পরিবারের পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ৩৯ জন, যেখানে সবচেয়ে ধনী পরিবারে তা মাত্র ২২।

মায়ের শিক্ষার সঙ্গেও শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। যেসব মায়ের কোনো শিক্ষা নেই বা প্রাথমিক পর্যন্ত পড়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে শিশু মৃত্যুর হার ৪৮। উচ্চশিক্ষিত মায়েদের ক্ষেত্রে তা নেমে আসে ২২–এ।

গর্ভকালীন সেবা বা অ্যান্টিনেটাল কেয়ারে (এএনসি) ধনী-দরিদ্র ব্যবধান আরও স্পষ্ট। ধনী পরিবারের ৯৯ শতাংশ গর্ভবতী নারী অন্তত একবার এএনসি পেয়েছেন, কিন্তু দরিদ্র পরিবারের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৮৪ শতাংশ।

গুণগত সেবায় ব্যবধান আরও বড়। গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার এএনসি নেওয়ার প্রস্তাবিত মানদণ্ড ধনী নারীদের ক্ষেত্রে ৬৮ শতাংশ পূরণ হলেও দরিদ্র নারীদের মধ্যে এ হার মাত্র ২৩ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শফিউন নাহিন শিমুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দরিদ্র ও কম শিক্ষিত শ্রেণির নারী-শিশুরা প্রায় সব সূচকেই পিছিয়ে। এটি উদ্বেগের, তবে নতুন কিছু নয়।’

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেশের উন্নয়ন সবার মাঝে সমানভাবে পৌঁছায়নি। সরকারি খাতে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবার অবদান তুলনামূলক কম থাকায় মানুষ বেসরকারি সেবার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যেখানে দরিদ্রদের প্রবেশাধিকার সীমিত।

কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক চাপ, মূল্যস্ফীতি আর খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়াও দরিদ্র পরিবারের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

শিমুল আরও বলেন, ‘এসব কারণ বৈষম্যকে আরও বাড়িয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল করার পাশাপাশি দরিদ্র ও কম শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।’

জরিপ অনুযায়ী, দরিদ্রতম পরিবারের ৩২ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির; ধনীদের মধ্যে এ হার ১৬ শতাংশ। দরিদ্র পরিবারের ১৫ শতাংশ শিশু দুর্বলতা বা স্বল্পমেয়াদি অপুষ্টিতে ভোগে; ধনীদের মধ্যে এ হার ১০ শতাংশ।

শিক্ষাক্ষেত্রেও বৈষম্য গভীর। দরিদ্র পরিবারের মাত্র ২১ শতাংশ শিশু উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করতে পারে, যেখানে ধনী পরিবারের ক্ষেত্রে এ হার ৬৬ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষাতেও একই প্রবণতা।

দীর্ঘদিন কমার পর মোট প্রজনন হার (টিএফআর) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৪–এ। দরিদ্রতম পরিবারের টিএফআর ২ দশমিক ৮, ধনীদের ২ দশমিক ২। শুধু প্রাথমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত নারীদের টিএফআর ২ দশমিক ৭; উচ্চশিক্ষিত নারীদের ২ দশমিক ১।

ময়মনসিংহ বিভাগে টিএফআর সর্বোচ্চ—২ দশমিক ৮। ২০২২ সালের জনগণনায় এই বিভাগেই সাক্ষরতার হার ছিল সবচেয়ে কম—৬৭ দশমিক ০৯ শতাংশ।

দরিদ্র পরিবারের প্রতি এক হাজার নারীর মধ্যে ১২০ জন কিশোরী বয়সে সন্তান জন্ম দিয়েছেন; ধনী পরিবারে এ হার ৬১।

নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে কিশোরী বয়সে জন্ম দেওয়ার হার প্রতি এক হাজারে ১৫৫, উচ্চশিক্ষিত নারীদের মধ্যে মাত্র ২০। জরিপ বলছে, শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বাড়ানোই কিশোরী মাতৃত্ব কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

বাল্যবিয়ে হওয়ার বড় কারণ দারিদ্র্য ও অশিক্ষা। দেশে মোট নারীদের ৪৭ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। কোনো শিক্ষা নেই বা শুধু প্রাক-প্রাথমিক পড়েছেন—এমন নারীদের মধ্যে এ হার ৬৯ শতাংশ, ধনীদের মধ্যে ১৩ শতাংশ।

দরিদ্র পরিবারের ৬৫ শতাংশ নারীর ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়; ধনীদের ক্ষেত্রে তা ৪২ শতাংশ।

ধনী পরিবারের ৬৮ শতাংশ নারীর সন্তান জন্ম হয় সিজারিয়ান সেকশনে (সি-সেকশন)। দরিদ্রদের ক্ষেত্রে এ হার ৩৪ শতাংশ, উচ্চশিক্ষিত নারীদের সি–সেকশন হার ৭৫ শতাংশ। কোনো শিক্ষা নেই এমন নারীদের মধ্যে তা মাত্র ২০ শতাংশ।

অন্যদিকে শিশুদের জন্মের পর দ্রুত দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে দেখা যায় উল্টো বৈষম্য। দরিদ্র নারীদের ৩৮ শতাংশ দ্রুত বুকের দুধ খাওয়ান। ধনী নারীদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ২৪ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত নারীদের মধ্যে এ হার ৩৫ শতাংশ; উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে ২৬ শতাংশ।

Related Articles

Latest Articles