4.9 C
New York

আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপি জোটে অসন্তোষ

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৭২টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করায় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। কারণ দলগুলো এখনো জানে না, তাদের জন্য কতটি আসন বরাদ্দ হতে পারে।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি আছে। অথচ শরিকদের সঙ্গে বিএনপি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি।

দলীয় সূত্র বলছে, বাকি থাকা ২৮টি আসনের মধ্যে মাত্র ১৫টি আসন শরিকদের জন্য ছাড়তে পারে বিএনপি। এই সংখ্যা শরিকদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। অন্য ১৩টি আসন নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের আশঙ্কায় ৬টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি, ৩টি আসন এখনো ফাঁকা কারণ বিএনপি নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী প্রার্থী পায়নি, আর ৪টি আসনে আসনসীমানা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে প্রার্থী ঘোষণা করেনি দলটি।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের কারণে দলটি ঝুঁকি নিতে চাইছে না। এই সংশোধনী অনুযায়ী, জোটের প্রার্থী হলেও সবাইকে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে, জোটের বড় দলের প্রতীকে নয়। এতে শরিকদের প্রার্থী দিলে আসন হারানোর আশঙ্কা রয়েছে মনে করছেন তারা।

বিএনপির সঙ্গে একযোগে আন্দোলনে থাকা প্রায় দুই ডজন সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, বিএনপি তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখছে না এবং তারা একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, জোটের নেতারা ‘বিস্মিত ও মর্মাহত’।

সৈয়দ এহসানুল হুদা কিশোরগঞ্জ–৫ আসনে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু বিএনপি সেখানে নিজ দলের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, ‘বিএনপি কি এখন আওয়ামী লীগের পুরনো পথে হাঁটছে? আওয়ামী লীগ এমন করত, তারা কিছু আসন ফাঁকা রাখত এবং শরিকদের কিছুই দিত না। বিএনপি সেদিকে হাঁটছে, তাই তাদের সঙ্গে জোটের শরিকদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।’

সাইফুল হক জানান, তিনি নিজে ঢাকা–৮ আসনে গণতন্ত্র মঞ্চের প্রার্থী। অথচ প্রথম দফার মনোনয়নে বিএনপি তার আসনে নিজ দলের প্রার্থী দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় দফাতেও বিএনপি এমন আসনগুলোতে প্রার্থী দিয়েছে, যেগুলো শরিকদের জন্য রাখা উচিত ছিল। ফলে এখন অবিশ্বাস, সন্দেহ ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।’

ঝালকাঠি–১ আসনে বিএনপি রফিকুল ইসলাম জামালকে মনোনয়ন দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান সেখানে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ইরান ঘোষণা দেন, বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না লেবার পার্টি।

তিনি বলেন, ‘বিএনপি তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাচ্ছে। তারা শরিকদের বাদ দিয়ে এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।’

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ফারিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল–২ আসনে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু বিএনপি সেখানেও নিজ দলের প্রার্থী দিয়েছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ফারিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘বিএনপির চরিত্রই এমন। তারা বিপদে পড়লে সবার সহযোগিতা চায়। আর যখন মনে করে একাই ক্ষমতায় যেতে পারবে তখন শরিকদের ভুলে যায়।’

বিএনপির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, পিরোজপুর–১ আসনটি সম্ভবত ১২–দলীয় জোটের জন্য রাখা হতে পারে। এই আসনে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার মনোনয়ন প্রত্যাশী।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘যেসব আসন শূন্য রাখা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে শরিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কোন আসন শরিকদের দেওয়া হবে তা পরে ঠিক করে জানানো হবে। তবে আসন বন্টন নিয়ে কে অসন্তোষ প্রকাশ করছে, সে বিষয়ে আমি এখনো জানি না।’

এর আগে ৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭টি আসনের একটি প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করে। পরের দিন মাদারীপুর–১ আসনের মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। এরপর ৪ ডিসেম্বর আরও ৩৬টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়।

সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত বিএনপি ২৭২টি আসনের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। বাকি ২৮টি আসনের ঘোষণা ‘সময়সূচি অনুযায়ী পরে দেওয়া হবে’ বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বিএনপি এখনো ২৮টি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। তবে দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, এর মধ্যে অন্তত ১৫টি আসন জোটের শরিকদের জন্য রাখা হতে পারে।

শূন্য থাকা আসনগুলোর মধ্যে নীলফামারী–১ উল্লেখযোগ্য। যেখানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে শাহরিন ইসলাম তুহিন এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মনজুরুল ইসলাম আফেন্দি মনোনয়নপ্রত্যাশী।

দলীয় সূত্র জানায়, শরিকদের সঙ্গে আলোচনা শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এছাড়া বগুড়া–২ আসনে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না জোটের প্রার্থী হিসেবে লড়বেন। একইভাবে পটুয়াখালী–৩ আসনে বিএনপি নিজ দলের প্রার্থী দেয়নি, কারণ গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সেখান থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে চান।

ঝিনাইদহ–২ ও ঝিনাইদহ–৪ আসনও শূন্য রেখেছে বিএনপি।

ঝিনাইদহ–২ আসনের জন্য গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এবং জেলা বিএনপি সভাপতি মনোনয়ন পেতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সূত্র বলছে, শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রার্থীকে সম্ভবত ঝিনাইদহ–৪ আসনে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে।

ঢাকা–১৩ আসনটি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজের জন্য রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে ঢাকা–১৭ আসনটি খালি রাখা হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থের জন্য।

এছাড়া বাগেরহাট–১, বাগেরহাট–২, বাগেরহাট–৩ এবং গাজীপুর–১ আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি। কারণ এসব আসনে সীমানা–সংক্রান্ত মামলাগুলো এখনো আপিল বিভাগে ঝুলে আছে।

শরিকদের জন্য বিবেচনায় থাকা অন্যান্য আসনের মধ্যে আছে, নারায়ণগঞ্জ–৪, সিলেট–৫, লক্ষ্মীপুর–১ ও লক্ষ্মীপুর–৪, চট্টগ্রাম–১৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ এবং ময়মনসিংহ–১০।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনে দুই শক্তিশালী মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেন, বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নেতা জুনায়েদ আল হাবিব।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া–৬ আসনে গণসংহতি আন্দোলন তাদের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে কুমিল্লা–৭ আসনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) তাদের মহাসচিব রেদওয়ান আহমেদকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

অভ্যন্তরীণ কোন্দলের আশঙ্কায় বিএনপি কমপক্ষে ছয়টি আসনে মনোনয়ন ঘোষণা করেনি। সবচেয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা গেছে লালমনিরহাট-২, ঝিনাইদহ-১, ঝিনাইদহ-৪, নরসিংদী-৩ এবং চট্টগ্রাম-১১ আসনে।

এ ছাড়া নীলফামারী-২, পাবনা-১ এবং ময়মনসিংহ-১০ আসনে ভালো প্রার্থীর অভাবে ফাঁকা রাখা হয়েছে।

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে জোট গঠনের আলোচনা চলছিল। কিন্তু বিএনপি ইতোমধ্যে এমন আসনে প্রার্থী দিয়েছে, যেখানে এনসিপি প্রার্থীদের নির্বাচনের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিএনপি ঢাকা-১১ আসনে এমএ কাইয়ুমের নাম ঘোষণা করেছে, অন্যদিকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একই আসনে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

এ ছাড়াও দলটি রংপুর-৪ আসনে এমদাদুল হক ভরসাকে মনোনয়ন দিয়েছে, যেখানে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।

দলটি ঢাকা-৯, ঢাকা-১৮, ঢাকা-১৪ এবং কুমিল্লা-৪ আসনেও প্রার্থী ঘোষণা করেছে, যেখানে এনসিপির তাসনিম জারা, নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী এবং আরিফুল ইসলাম আদিবের প্রার্থী হওয়ার কথা রয়েছে।

Related Articles

Latest Articles